ইসলানিক উপন্যাস। মহিয়সী নারী। পর্ব ৬
ইসলামিক উপন্যাস। মহিয়সী নারী পর্ব ৬.
দুইদিন পর। মাযহারুল ইসলাম সাহেব হাসপাতালের বেডে মুমূর্ষ অবস্থায় আছেন। এখনো জ্ঞান ফিরছে না। তার পরিবার-পরিজনের চরম উতকন্ঠা। চেস্টা- তদবীরও কম করা হচ্ছেনা। কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। নাজিফা বাবার পাশে বসে কুরআন তেলাওয়াত করছে। আর আমেনা বেগম আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে দোয়া করছেন স্বামীর জ্ঞান ফিরা ও রোগমুক্তির জন্যে। এমন সময় হঠাত মাযহারুল ইসলাম সাহেবের জ্ঞান ফিরে এলো। জ্ঞান ফিরা পরে তিনি উচ্চ স্বরে বললেন- হে আমার দয়ালু আল্লাহ্! আমাকে দয়া করো। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এ বাক্যগুলো তিনি কয়েকবার উচ্চারণ করলেন। স্বামীর জ্ঞান ফিরে আসায় খুশি হলেন আমেনা বেগম। আনন্দে আত্নহারা হয়ে নাজিফা বাবা বাবা বলে ডাকতে লাগলো। কিন্তু নাজিফার বাবা ডাকে সাড়া দিলেন না। তিনি বরং বাক্যগুলো বলা শেষ হওয়ার পর পুনরায় জ্ঞান হারালেন। সেই সাথে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে পরপারের যাত্রী হলেন। মুহূর্তেই মাযহার সাহেবের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। কান্নার রোল পড়ে গেলো বাড়ি জুড়ে। ভারী হয়ে উঠলো আকাশ- বাতাশ। রাত ৮ টা ৩০ মিনিট। মাযহার সাহেবের জানাযা নামাজ অনুসঠিত হবে এখনই। তার জানাযা নামার পড়ার জন্যে কোন মাইকিং করা হয়নি। তথাপি জানাযার নামাজে এত বিপুল সংখ্যক মানুষ জরো হয়েছে, যেনো তারা পূর্ব থেকেই জানেন যে, আজ মাযহার সাহেব মারা যাবেন এবং রাত ৮ টা ৩০ মিনিটে তার জানাযা অনুসঠিত হবে। ব্যাপারটা সত্যিই বিস্ময়কর। জানাযার নামাজ শেষ হলো। দাফন কার্য সম্পাদন হলো। শামছুর রহমান সাহেব ঈমাম সাহেবকে বললেন- হুজুর! মাযহারুল ইসলাম সাহেবের অকাল মৃত্যুতে নাজিফা ও নাজিফার মা খুব ভেংগে পড়েছে। ভীষণ কান্নাকাটি করছে। আপনি যদি তাদেরকে কুরআন - হাদীসের আলোকে একটু বুঝিয়ে দিতেন, ভাল হত।
ঈমাম সাহেব বললেন তা বুঝাব। তবে এর আগে আপনাকে একটি কথা বুঝানো প্রয়োজন। কি কথা? কথাটি হলো - আপনি যে বললেন, মাযহারুল ইসলামের অকাল মৃত্যু - এই অকাল মৃত্যু কথাটি সম্পর্কে আপনাকে একটু বুঝাতে চাই। এটা তো অকাল মৃত্যু। এখানে বুঝাবুঝির কি আছে? অল্প বয়সে মারা গেলে তো অকাল মৃত্যুই বলা হয়। হ্যা বলা হয় ঠিক। কিন্তু এরুপ বলা মোটেও উচিত নয়। কারণ মানুষ এর সাধারণত একটি বয়সক্রম বা নিয়মতান্ত্রিক জীবনচক্র থাকে। এই জীবনচক্র অনুযায়ী মানুষ এর জীবন শৈশব, কৈশোর, যৌবন প্রভৃতি পর্যায় অতিক্রম করে পরিশেষ বার্ধক্য উপনীত হয়। আর তখন কোন এক সময় মৃত্যুদূত এসে ডাক দেয় এবং স্বাভাবিকভাবেই সে তার ডাকে সারা দিয়ে পরপারে পাড়ি জমায়। মানুষ এর এ সময়ের মৃত্যুকে সাধারণ লোকেরা স্বাভাবিক মৃত্যু বলেই আখ্যায়িত করে। তাই যখন কোন মানুষ জীবনচক্রের সমস্ত ধাপ অতিক্রম করার পূর্বে নানাবিধ রোগে- শোকে আক্রান্ত হয়ে কিংবা দুর্ঘটনার কবলে পতিত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, তখন কেউ কেউ অজ্ঞতাবশত এ মৃত্যুকে অকাল মৃত্যু হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং বলে যে, অমুকের অকাল মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে বুঝা যায়- অকাল মৃত্যু বলে কিছুই নেই।
বরং যে ব্যক্তি বার্ধক্য আসার পূর্বেই কোনো রোগে বা দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরন করেছে, এটা তার স্বাভাবিক মৃত্যু বলেই আখ্যায়িত হবে। কেননা তার তাকদীরে এভাবে মৃত্যু হবে বলেই লেখা ছিলো। তার সেভাবেই মৃত্যু হয়েছে। সুতরাং তা তার জন্যে নিঃসন্দেহে স্বাভাবিক মৃত্যু। বুঝেছেন শামছুর রহমান সাহেব? তা তো বুঝলাম। কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যুর একটা ক্রমপরম্পরা থাকা দরকার। ক্রমপরম্পরা ব্যতীত যে মৃত্যুটি হবে, সে মৃত্যুটিকে কি আমরা অকাল মৃত্যু বলবনা? আমি তো বললামই - অকাল মৃত্যু বলে কিছু নেই। প্রত্যেকেই তার জন্যে নির্ধারিত সময়েই মৃত্যুবরন করে। যে ব্যক্তি যে পরিমান হায়াত নিয়ে পৃথিবীতে আসে, যে পরিমান জীবনকাল তার তাকদীরে লেখা থাকে, কেবল সে পরিমান সময়ই সে পৃথিবীতে বেচে থাকে। এরপরই তার মৃত্যু হয়। কোনো মানুষ পৃথিবীতে একশ না তার বেশী বছরের জীবন লাভ করে। আবার কেউ মধ্যম বয়সের জীবন পায়। আবার কেউ জন্মের সাথে সাথে মৃত্যুবরন করে। এটা এ কারনে হয় যে, সকলেরই মৃত্যুর নিদির্স্ট সময় লিপিবদ্ধ থাকে। আর যার মৃত্যুর সময় যখন লেখা আছে তখনই সে মৃত্যুবরন করবে। একটুও আগুপিছু হয়না। সুতরাং মানুষ যখনই মারা যায়, তার নির্দিস্ট সময়েই মারা যায়। কাজেই কোন মৃত্যুই অকাল মৃত্যু নয়, বরং প্রত্যেকেই তার নির্দিস্ট সময়ে এবং তার জন্যে নির্দিস্ট করে রাখা অবস্থাতেই সে মৃত্যুবরন করে। আর আপনি যে বললেন, স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্যে ধারাবাহিকতা থাকা দরকার, তা ঠিক নয়। ভাল করে বুঝুন। মানুষ এর পৃথিবীতে আসার একটি ক্রমপরম্পরা রয়েছে। রয়েছে একটি নির্দিস্ট ধারাবাহিকতা। প্রথমে পৃথিবীতে আসেন দাদা-দাদী নানা- নানী, অতঃপর মা-বাবা, এরপর বড় ভাই বোন... তারপর পৃথিবীর আলো দেখতে পায় ছোটরা। জন্মের ক্ষেত্রে মানুষ এর এ ধরনের ধারাবাহিকতা থাকলেও মৃত্যুর ক্ষেত্রে সিরিয়াল বা ধারাবাহিকতা নেই। কেউ পৃথিবীতে আগে এলে, সে আগে মৃত্যুবরন করবে, আর কেউ পরে এলে পরে মৃত্যুবরন করবে এমন কোনো কথা নেই।
তাই তো দেখা যায়- অনেক সময় সন্তান তার পিতা-মাতার আগে মারা যায়। ছোটরা ইহধাম ত্যাগ করে বড়দের আগে। কেউ মারা যায় অশীপতির বৃদ্ধ বয়সে। এ সবই হয় তাকদীরের ফায়ছালা অনুযায়ী। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ তায়ালা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন- প্রত্যেকেরই নির্দিস্ট জীবনকাল রয়েছে। এরপর যখন তাদের মৃত্যুর সময় আসে, তখন তা মুহূর্তকাল পরিমানও আগুপিছু করা হয় না। [সুরা নাহল আয়াতঃ ৬১] আসল কথা হলো আমাদের দেশে অকাল মৃত্যু নামে ভ্রান্ত কথা ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের প্রচলন শুরু হয়েছে। তাই আপনি মাযহারুল ইসলাম সাহেবের মৃত্যুকে অকাল মৃত্যু বলছেন। তাই না...?? জ্বী তাই। আপনার ভ্রান্ত ধারনা ও বিশ্বাস কি এখন দূর হয়েছে...?? জ্বী, হুজুর আপনার মুল্যবান আলোচনা শুনে আমি বুঝতে পেরেছি- প্রকৃতপক্ষে অকাল মৃত্যু বলে কিছুই নেই। যারা বলে যে, অমুকের অকাল মৃত্যু হয়েছে তারা তাদের নির্বুদ্ধিতা ও অজ্ঞতার কারনেই এমনটি বলে থাকে। আলহামদুলিল্লাহ্! শুনে খুশি হলাম। এরপর শামছুর রহমান সাহেব ঈমাম সাহেবকে নিয়ে নাজিফাদের বাসায় গেলেন। বসার রুমে বসতে দিলেন। তিনি নিজেও বসলেন তার সাথে। নাজিফাকে ডেকে বললেন নাজিফা- তোমার মাকে নিয়ে তুমি পাশের রুমে বসো। ঈমাম সাহেব তোমাদের কিছু কথা বলবেন। এরপর নাজিফা ও আমেনা বেগম পাশের রুমে বসলেন। ঈমাম সাহেব তাদের উদ্দেশ্য বলতে শুরু করলেন- মানুষ দুনিয়াতে চিরদিন থাকার জন্যে আসেনা। আসার সময় তারা যাওয়ার টিকেট নিয়েই আসে। যে দুনিয়াতে ভাল কাজ করে এবং তার দুনিয়াটা ছেড়ে যাওয়াটা ঈমানের সাথে হয় সেই প্রকৃত সফলকাম। মাযহারুল ইসলামের মৃত্যু ও মৃত্যুর পরবর্তী বর্ণনা শুনে বুঝতে পারলাম মৃত্যুটা খুবই ভাল হয়েছে। এ ধরনের মৃত্যু সকলের ভাগ্যে জোটে না।
যাদেরকে মহান আল্লাহ্ পাক বিশেষ অনুগ্রহ দান করেন, তাদেরকেই তিনি ঈমানের সাথে মৃত্যু দান করেন। সুতরাং মাযহারুল সাহেবের মৃত্যুতে দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। বরং তার মৃত্যু যে ঈমানের সাথে হয়েছে, সে জন্যে শোকরিয়া আদায় করা উচিৎ। হাদীস শরীফে আছে- হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমর রাযিঃ বলেন, আমরা দশজন সাহাবী রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হলাম। একজন আনসারী সাহাবী দাঁড়ালেন এবং বললেন, হে আল্লাহ্ তায়ালার নবী মানুষ এর মধ্যে সর্বশ্রেস্ট জ্ঞানী এবং অধিক হুশিয়ার ব্যক্তি কে.? রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যারা মৃত্যুকে বেশী বেশী স্বরন করে, মৃত্যুর জন্যে বেশি বেশি প্রস্তুতি গ্রহন করে এবং দুনিয়ার গৌরব ও আখিরাতের মর্যাদা নিয়ে চলে যায়। [তারবানী, ইবনে মাযাহ] আর মাযহারুল ইসলাম সাহেবের মৃত্যুতে আপনারা যদি ছবুর করতে পারেন এবং আল্লাহ্ তায়ালার সিদ্ধান্তের উপর রাজী ও খুশী থাকতে পারেন, তাহলে আপনাদের মতো ছবুর কারীর সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুসংবাদ দিয়েছেন। হাদীস শরীফে আছে- হযরত আবু হুরাইরা রাযিঃ থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ মুবারক করেছেন, আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন- আমার মুমিন বান্দার জন্যে আমার নিকট জান্নাত ছাড়া আর কোন পুরস্কার নেই ; যখন আমি দুনিয়া থেকে তার প্রিয়জনকে উঠিয়ে নিই ; আর সে ছাওয়াবের আসায় ছবুর অবলম্বন করে। [বুখারী শরীফ] তবে ছবুর করার অর্থ এইনয় যে, নীরবেও কাদা যাবেনা এবং অন্তরে ব্যাথা অনুভব করা যাবে না। ছবুর অবলম্বনের ছাওয়াব শুধু তখনই নস্ট হয়, যখন শোকে অধীর হয়ে পরিধেয় বস্ত্র ছিড়ে ফেলা হয়, চিৎকার করে কান্নাকাটি করা হয় এবং অতিমাত্রায় অভিযোগ করা হয়। কিন্তু বুযুর্গগণ বলেন- কারো উপর বিপদ বা দুঃখ-কস্ট আসলে তাকে দুঃখিত বলে যদি অপর লোক থেকে চিনতে পারা না যায় অর্থাৎ শোকের কারনে তার বাহ্যিক আকৃতিতে কোনো পরিবর্তন না ঘটে, তবে এমন ছবুরকে সবরুন জামীল ( সর্বাঙ্গ সুন্দর সবর) বলে। তাই আমি আশা করবো আপনারা সবরুন জামীল গ্রহন করবেন।
এরপরে ঈমাম সাহেব নাজিফাদের বাসা থেকে চলে এলেন।
প্রিয় পাঠক, ৭ নম্বর পর্ব আগামীকাল ইনশাআল্লাহ আপনাদের মাঝে প্রকাশ করবো দোয়া করিবেন, মহান আল্লাহ্ তায়ালা আমাকে যেন সফলতা দান করেন, এবং আল্লাহ্ তায়ালা আমাকে দ্বীনের খেদমতে কবুল করেন। আমীন ছুম্মা আমীন -----------------------------------------------------------------------
সিরিজঃ মহীয়সী নারী। পার্ঠ (৬)
লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মাদ মফীজুল ইসলাম
সংকলনেঃ আমি হাফেজ মুহাম্মাদ জিয়াউর রহমান
দুইদিন পর। মাযহারুল ইসলাম সাহেব হাসপাতালের বেডে মুমূর্ষ অবস্থায় আছেন। এখনো জ্ঞান ফিরছে না। তার পরিবার-পরিজনের চরম উতকন্ঠা। চেস্টা- তদবীরও কম করা হচ্ছেনা। কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। নাজিফা বাবার পাশে বসে কুরআন তেলাওয়াত করছে। আর আমেনা বেগম আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে দোয়া করছেন স্বামীর জ্ঞান ফিরা ও রোগমুক্তির জন্যে। এমন সময় হঠাত মাযহারুল ইসলাম সাহেবের জ্ঞান ফিরে এলো। জ্ঞান ফিরা পরে তিনি উচ্চ স্বরে বললেন- হে আমার দয়ালু আল্লাহ্! আমাকে দয়া করো। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এ বাক্যগুলো তিনি কয়েকবার উচ্চারণ করলেন। স্বামীর জ্ঞান ফিরে আসায় খুশি হলেন আমেনা বেগম। আনন্দে আত্নহারা হয়ে নাজিফা বাবা বাবা বলে ডাকতে লাগলো। কিন্তু নাজিফার বাবা ডাকে সাড়া দিলেন না। তিনি বরং বাক্যগুলো বলা শেষ হওয়ার পর পুনরায় জ্ঞান হারালেন। সেই সাথে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে পরপারের যাত্রী হলেন। মুহূর্তেই মাযহার সাহেবের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। কান্নার রোল পড়ে গেলো বাড়ি জুড়ে। ভারী হয়ে উঠলো আকাশ- বাতাশ। রাত ৮ টা ৩০ মিনিট। মাযহার সাহেবের জানাযা নামাজ অনুসঠিত হবে এখনই। তার জানাযা নামার পড়ার জন্যে কোন মাইকিং করা হয়নি। তথাপি জানাযার নামাজে এত বিপুল সংখ্যক মানুষ জরো হয়েছে, যেনো তারা পূর্ব থেকেই জানেন যে, আজ মাযহার সাহেব মারা যাবেন এবং রাত ৮ টা ৩০ মিনিটে তার জানাযা অনুসঠিত হবে। ব্যাপারটা সত্যিই বিস্ময়কর। জানাযার নামাজ শেষ হলো। দাফন কার্য সম্পাদন হলো। শামছুর রহমান সাহেব ঈমাম সাহেবকে বললেন- হুজুর! মাযহারুল ইসলাম সাহেবের অকাল মৃত্যুতে নাজিফা ও নাজিফার মা খুব ভেংগে পড়েছে। ভীষণ কান্নাকাটি করছে। আপনি যদি তাদেরকে কুরআন - হাদীসের আলোকে একটু বুঝিয়ে দিতেন, ভাল হত।
ঈমাম সাহেব বললেন তা বুঝাব। তবে এর আগে আপনাকে একটি কথা বুঝানো প্রয়োজন। কি কথা? কথাটি হলো - আপনি যে বললেন, মাযহারুল ইসলামের অকাল মৃত্যু - এই অকাল মৃত্যু কথাটি সম্পর্কে আপনাকে একটু বুঝাতে চাই। এটা তো অকাল মৃত্যু। এখানে বুঝাবুঝির কি আছে? অল্প বয়সে মারা গেলে তো অকাল মৃত্যুই বলা হয়। হ্যা বলা হয় ঠিক। কিন্তু এরুপ বলা মোটেও উচিত নয়। কারণ মানুষ এর সাধারণত একটি বয়সক্রম বা নিয়মতান্ত্রিক জীবনচক্র থাকে। এই জীবনচক্র অনুযায়ী মানুষ এর জীবন শৈশব, কৈশোর, যৌবন প্রভৃতি পর্যায় অতিক্রম করে পরিশেষ বার্ধক্য উপনীত হয়। আর তখন কোন এক সময় মৃত্যুদূত এসে ডাক দেয় এবং স্বাভাবিকভাবেই সে তার ডাকে সারা দিয়ে পরপারে পাড়ি জমায়। মানুষ এর এ সময়ের মৃত্যুকে সাধারণ লোকেরা স্বাভাবিক মৃত্যু বলেই আখ্যায়িত করে। তাই যখন কোন মানুষ জীবনচক্রের সমস্ত ধাপ অতিক্রম করার পূর্বে নানাবিধ রোগে- শোকে আক্রান্ত হয়ে কিংবা দুর্ঘটনার কবলে পতিত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, তখন কেউ কেউ অজ্ঞতাবশত এ মৃত্যুকে অকাল মৃত্যু হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং বলে যে, অমুকের অকাল মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে বুঝা যায়- অকাল মৃত্যু বলে কিছুই নেই।
বরং যে ব্যক্তি বার্ধক্য আসার পূর্বেই কোনো রোগে বা দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরন করেছে, এটা তার স্বাভাবিক মৃত্যু বলেই আখ্যায়িত হবে। কেননা তার তাকদীরে এভাবে মৃত্যু হবে বলেই লেখা ছিলো। তার সেভাবেই মৃত্যু হয়েছে। সুতরাং তা তার জন্যে নিঃসন্দেহে স্বাভাবিক মৃত্যু। বুঝেছেন শামছুর রহমান সাহেব? তা তো বুঝলাম। কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যুর একটা ক্রমপরম্পরা থাকা দরকার। ক্রমপরম্পরা ব্যতীত যে মৃত্যুটি হবে, সে মৃত্যুটিকে কি আমরা অকাল মৃত্যু বলবনা? আমি তো বললামই - অকাল মৃত্যু বলে কিছু নেই। প্রত্যেকেই তার জন্যে নির্ধারিত সময়েই মৃত্যুবরন করে। যে ব্যক্তি যে পরিমান হায়াত নিয়ে পৃথিবীতে আসে, যে পরিমান জীবনকাল তার তাকদীরে লেখা থাকে, কেবল সে পরিমান সময়ই সে পৃথিবীতে বেচে থাকে। এরপরই তার মৃত্যু হয়। কোনো মানুষ পৃথিবীতে একশ না তার বেশী বছরের জীবন লাভ করে। আবার কেউ মধ্যম বয়সের জীবন পায়। আবার কেউ জন্মের সাথে সাথে মৃত্যুবরন করে। এটা এ কারনে হয় যে, সকলেরই মৃত্যুর নিদির্স্ট সময় লিপিবদ্ধ থাকে। আর যার মৃত্যুর সময় যখন লেখা আছে তখনই সে মৃত্যুবরন করবে। একটুও আগুপিছু হয়না। সুতরাং মানুষ যখনই মারা যায়, তার নির্দিস্ট সময়েই মারা যায়। কাজেই কোন মৃত্যুই অকাল মৃত্যু নয়, বরং প্রত্যেকেই তার নির্দিস্ট সময়ে এবং তার জন্যে নির্দিস্ট করে রাখা অবস্থাতেই সে মৃত্যুবরন করে। আর আপনি যে বললেন, স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্যে ধারাবাহিকতা থাকা দরকার, তা ঠিক নয়। ভাল করে বুঝুন। মানুষ এর পৃথিবীতে আসার একটি ক্রমপরম্পরা রয়েছে। রয়েছে একটি নির্দিস্ট ধারাবাহিকতা। প্রথমে পৃথিবীতে আসেন দাদা-দাদী নানা- নানী, অতঃপর মা-বাবা, এরপর বড় ভাই বোন... তারপর পৃথিবীর আলো দেখতে পায় ছোটরা। জন্মের ক্ষেত্রে মানুষ এর এ ধরনের ধারাবাহিকতা থাকলেও মৃত্যুর ক্ষেত্রে সিরিয়াল বা ধারাবাহিকতা নেই। কেউ পৃথিবীতে আগে এলে, সে আগে মৃত্যুবরন করবে, আর কেউ পরে এলে পরে মৃত্যুবরন করবে এমন কোনো কথা নেই।
তাই তো দেখা যায়- অনেক সময় সন্তান তার পিতা-মাতার আগে মারা যায়। ছোটরা ইহধাম ত্যাগ করে বড়দের আগে। কেউ মারা যায় অশীপতির বৃদ্ধ বয়সে। এ সবই হয় তাকদীরের ফায়ছালা অনুযায়ী। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ তায়ালা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন- প্রত্যেকেরই নির্দিস্ট জীবনকাল রয়েছে। এরপর যখন তাদের মৃত্যুর সময় আসে, তখন তা মুহূর্তকাল পরিমানও আগুপিছু করা হয় না। [সুরা নাহল আয়াতঃ ৬১] আসল কথা হলো আমাদের দেশে অকাল মৃত্যু নামে ভ্রান্ত কথা ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের প্রচলন শুরু হয়েছে। তাই আপনি মাযহারুল ইসলাম সাহেবের মৃত্যুকে অকাল মৃত্যু বলছেন। তাই না...?? জ্বী তাই। আপনার ভ্রান্ত ধারনা ও বিশ্বাস কি এখন দূর হয়েছে...?? জ্বী, হুজুর আপনার মুল্যবান আলোচনা শুনে আমি বুঝতে পেরেছি- প্রকৃতপক্ষে অকাল মৃত্যু বলে কিছুই নেই। যারা বলে যে, অমুকের অকাল মৃত্যু হয়েছে তারা তাদের নির্বুদ্ধিতা ও অজ্ঞতার কারনেই এমনটি বলে থাকে। আলহামদুলিল্লাহ্! শুনে খুশি হলাম। এরপর শামছুর রহমান সাহেব ঈমাম সাহেবকে নিয়ে নাজিফাদের বাসায় গেলেন। বসার রুমে বসতে দিলেন। তিনি নিজেও বসলেন তার সাথে। নাজিফাকে ডেকে বললেন নাজিফা- তোমার মাকে নিয়ে তুমি পাশের রুমে বসো। ঈমাম সাহেব তোমাদের কিছু কথা বলবেন। এরপর নাজিফা ও আমেনা বেগম পাশের রুমে বসলেন। ঈমাম সাহেব তাদের উদ্দেশ্য বলতে শুরু করলেন- মানুষ দুনিয়াতে চিরদিন থাকার জন্যে আসেনা। আসার সময় তারা যাওয়ার টিকেট নিয়েই আসে। যে দুনিয়াতে ভাল কাজ করে এবং তার দুনিয়াটা ছেড়ে যাওয়াটা ঈমানের সাথে হয় সেই প্রকৃত সফলকাম। মাযহারুল ইসলামের মৃত্যু ও মৃত্যুর পরবর্তী বর্ণনা শুনে বুঝতে পারলাম মৃত্যুটা খুবই ভাল হয়েছে। এ ধরনের মৃত্যু সকলের ভাগ্যে জোটে না।
যাদেরকে মহান আল্লাহ্ পাক বিশেষ অনুগ্রহ দান করেন, তাদেরকেই তিনি ঈমানের সাথে মৃত্যু দান করেন। সুতরাং মাযহারুল সাহেবের মৃত্যুতে দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। বরং তার মৃত্যু যে ঈমানের সাথে হয়েছে, সে জন্যে শোকরিয়া আদায় করা উচিৎ। হাদীস শরীফে আছে- হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমর রাযিঃ বলেন, আমরা দশজন সাহাবী রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হলাম। একজন আনসারী সাহাবী দাঁড়ালেন এবং বললেন, হে আল্লাহ্ তায়ালার নবী মানুষ এর মধ্যে সর্বশ্রেস্ট জ্ঞানী এবং অধিক হুশিয়ার ব্যক্তি কে.? রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যারা মৃত্যুকে বেশী বেশী স্বরন করে, মৃত্যুর জন্যে বেশি বেশি প্রস্তুতি গ্রহন করে এবং দুনিয়ার গৌরব ও আখিরাতের মর্যাদা নিয়ে চলে যায়। [তারবানী, ইবনে মাযাহ] আর মাযহারুল ইসলাম সাহেবের মৃত্যুতে আপনারা যদি ছবুর করতে পারেন এবং আল্লাহ্ তায়ালার সিদ্ধান্তের উপর রাজী ও খুশী থাকতে পারেন, তাহলে আপনাদের মতো ছবুর কারীর সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুসংবাদ দিয়েছেন। হাদীস শরীফে আছে- হযরত আবু হুরাইরা রাযিঃ থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ মুবারক করেছেন, আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন- আমার মুমিন বান্দার জন্যে আমার নিকট জান্নাত ছাড়া আর কোন পুরস্কার নেই ; যখন আমি দুনিয়া থেকে তার প্রিয়জনকে উঠিয়ে নিই ; আর সে ছাওয়াবের আসায় ছবুর অবলম্বন করে। [বুখারী শরীফ] তবে ছবুর করার অর্থ এইনয় যে, নীরবেও কাদা যাবেনা এবং অন্তরে ব্যাথা অনুভব করা যাবে না। ছবুর অবলম্বনের ছাওয়াব শুধু তখনই নস্ট হয়, যখন শোকে অধীর হয়ে পরিধেয় বস্ত্র ছিড়ে ফেলা হয়, চিৎকার করে কান্নাকাটি করা হয় এবং অতিমাত্রায় অভিযোগ করা হয়। কিন্তু বুযুর্গগণ বলেন- কারো উপর বিপদ বা দুঃখ-কস্ট আসলে তাকে দুঃখিত বলে যদি অপর লোক থেকে চিনতে পারা না যায় অর্থাৎ শোকের কারনে তার বাহ্যিক আকৃতিতে কোনো পরিবর্তন না ঘটে, তবে এমন ছবুরকে সবরুন জামীল ( সর্বাঙ্গ সুন্দর সবর) বলে। তাই আমি আশা করবো আপনারা সবরুন জামীল গ্রহন করবেন।
এরপরে ঈমাম সাহেব নাজিফাদের বাসা থেকে চলে এলেন।
প্রিয় পাঠক, ৭ নম্বর পর্ব আগামীকাল ইনশাআল্লাহ আপনাদের মাঝে প্রকাশ করবো দোয়া করিবেন, মহান আল্লাহ্ তায়ালা আমাকে যেন সফলতা দান করেন, এবং আল্লাহ্ তায়ালা আমাকে দ্বীনের খেদমতে কবুল করেন। আমীন ছুম্মা আমীন -----------------------------------------------------------------------
সিরিজঃ মহীয়সী নারী। পার্ঠ (৬)
লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মাদ মফীজুল ইসলাম
সংকলনেঃ আমি হাফেজ মুহাম্মাদ জিয়াউর রহমান





No comments
Post a Comment